নিজেদের এক শতক জায়গা না থাকলেও প্রায় ৫ হাজার একর জমিতে ডেসটিনি’র বনায়ন

নিজেদের নামে এক শতক জায়গা না থাকা স্বত্বেও ডেসটিনি কর্তৃপক্ষ বান্দরবানে প্রায় ৫ হাজার একর জমিতে ট্রি প্যান্টেশন করেছে। শুধু তাই নয় তারা প্রশাসন ও সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে এসব জমি নিজস্ব সম্প্রত্তি উলেখ করে বনায়নের বিশাল বিশাল ছবিসহ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। এবং এসব বনায়নের শেয়ার বিক্রিও করছে।
ডেসটিনির এ ধরনের প্রতারনায় সকল মহল হতভম্ব হয়ে পড়েছে।
অনুসন্ধানে ডেসটিনির নানা অনিয়ম, সরকারি নিয়ম নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে হাজার হাজার একর জমিতে বনায়নের নামে সরকারি সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়া ও আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে তাদের জমি দখল করে নেয়ার তথ্য বেরিয়ে আসছে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ডেসটিনি বান্দরবানের লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি ও সদর উপজেলায় প্রায় ৫ হাজার একর জমি অবৈধ ও নিয়ম বহির্ভূতভাবে সেখানে বনায়ন করার বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়লে জেলা প্রশাসন থেকে চিঠি দিয়ে ডেসটিনির বনায়ন কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। উপজেলা প্রশাসন সংশিষ্ট এলাকায় ডেসটিনির বনায়ন কার্যক্রম বন্ধ রাখতে মাইকিংসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে থেমে নেই ডেসটিনিও। তারা উদ্ধতন মহলকে ম্যানেজ করে বনায়ন কার্যক্রম চালুর নানা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ডেসটিনি’র নিজস্ব নামে বান্দরবানে কোথাও কোনো জমি নেই। অথচ তারা বান্দরবানের ৪ উপজেলার ২২টি মৌজায় প্রায় পাঁচ হাজার একর জমিতে বনায়ন কার্যক্রম চালায়। ইতিমধ্যে ডেসটিনি বান্দরবান সদর উপজেলায় ৭৬৫ একর জমিতে বনায়ন করেছে। এরমধ্যে টংকাবতী মৌজায় ১৫ একর একর, চেমীডলু-এ ৫০০ একর, কুহালং-এ ২৫ একর, সুয়ালকে ২৫ একর ও কৌলাক্ষ্যং মৌজায় ৭৫ একর; আলীকদমের ৩৯১ নং তৈনফা মৌজায় ১৫০ একর; নাইক্ষ্যংছড়ি’র নাইক্ষ্যংছড়ি মৌজায় ১৫০ একর, ঈদগড়-এ ১০০ একর ও আলিক্ষ্যং মৌজায় ১২৫ একর জমিতে বনায়ন করা হয়েছে। তবে তারা সবচেয়ে বেশি বনায়ন করে লামা উপজেলায়। এ উপজেলার ফাঁসিয়াখালী মৌজায় ১২৫ একর, ফাইতং-এ ১৪৫ একর, কুমারী-তে ৮২৫ একর, লেমুপালং এ ৩০০ একর, ইয়াংছা’য় ৮৫০ একর, গজালিয়ায় ১০০ একর এবং আজিজনগর মৌজায় ১৮০ একর জমিতে তারা অবৈধভাবে বনায়ন করেছে। তবে সূত্র দাবি করে এটিই চূড়ান্ত নয়, এর বাইরেও অনেক রাবার বাগানের পটে তারা বনায়ন করেছে। আদিবাসীদের বিপুল পরিমাণ জমি জবর দখল করেও তারা বনায়ন করেছে।

মাঠ পর্যায়ে তদন্ত এবং লামার ইউএনও মোঃ নুরুজ্জামান ও নাইক্ষ্যংছড়ির ইউএনও নওয়াব আসলাম হাবিব সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তাদের উপজেলায় ডেসটিনির নামে কোনো জমি না থাকা স্বত্বেও তারা নিজস্ব জমি উলেখ করে কয়েক হাজার একর জমিতে বনায়নের তথ্য পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে তারা জেলা প্রশাসনকে অবহিত করেছেন।

জানা যায়, ডেসটিনি আদিবাসীদের জমি দখলের পাশাপাশি হর্টিকালচর ও রাবার বাগানের জন্য নেয়া ইজারা প্লটে বনায়ন কার্যক্রম করছে। ইজারাগ্রহীতাদের সাথে নিয়ম বর্হিভূত চুক্তির মাধ্যমে তারা এ বনায়ন চালিয়ে আসছে। বিষয়টি জেলা ও উপজেলা প্রশাসন জানলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। গত ১৭/০৭/২০০৯ ইং তারিখে লামা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে সহকারী কমিশনার (ভূমি) (এসি ল্যান্ড) মাঠ পর্যায়ের তদন্ত করে জেলা প্রশাসনকে যে প্রতিবেদন দাখিল করে সেখানে শুধুমাত্র লামা উপজেলা ২৮৬ নং ফাঁসিয়াখালী মৌজায় ১৭ রাবার পট ইজারা গ্রহীতার কাছ থেকে প্রায় ৩০০ একর জমি নিয়ে সেখানে বনায়ন কার্যক্রম চালানোর কথা উলেখ করা হয়। এরমধ্যে রয়েছে- মেসার্স রূপালী ট্রেডার্স, কান্দিরপাড় কুমিলা এর মালিকানাধীন ২০ একর, মমতাজ উদ্দিন মেডিকেল স্টাফ কোয়ার্টার, ঢাকা’র ১০ একর, ফৌজ মোহাম্মদ লালবাগ ঢাকা’র ১৩ একর, মেসার্স ওয়েব লিংক নন্দনকানন চট্টগ্রাম’র ১৭ একর, মেসার্স মাতামুহুরী প্যান্টার্স, মাদারবাড়ি, চট্টগ্রাম’র ১৭ একর, শাহ আলম ডুলাহাজারা কক্সবাজার’র ১৭ একর, এগ্রো করপোরেশন দিলকুশা ঢাকা’র ১৭ একর, বদিউর রহমান ডুলাহাজারা কক্সবাজার’র ১৭ একর, আবুল হাসানাত সিনহা মিরপুর ঢাকা’র ১৫ একর, মেসার্স নুর আহামদ অ্যান্ড সন্স মহেশখালী চট্টগ্রাম’র ১৮ একর, মেসার্স কাশেম করপোরেশন নবাব সিরাজদ্দৌলা রোড চট্টগ্রাম’র ১৫ একর, বদিউর রহমান ডুলাহাজারা কক্সবাজার’র ১৭ একর (২য় দফা), জামাল উদ্দিন চৌধুরী লক্ষ্মীবাজার ঢাকা’র ১৫ একর, চট্টলা রাবার টেরী বাজার চট্টগ্রাম’র ১৭ একর, প্রাচী কনস্ট্রাকশন নালাপাড়া চট্টগ্রাম’র ১৫ একর, সামশুদ্দিন আহমদ ফটিকছড়ি চট্টগ্রাম’র ২০ একর, এনামুল হক মিরপুর ঢাকা’র ১৭ একর এবং নুরুল ইসলাম হায়দার লামা বান্দরবান এর মালিকানাধীন ১৮ একর জমি। এভাবেই তারা হর্টিকালচার ও রাবার বাগানের নামে নেয়া ৪০ বছর মেয়াদী ইজারা প্লট প্রশাসন বা সরকারের অনুমতি ছাড়াই বনায়ন করছে। তবে ডেসটিনির থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে লামা উপজেলার ইয়াংছা মৌজার কাঁঠালছড়ার ৯৩ আদিবাসী পরিবার তাদের জমি অবৈধভাবে দখলে নিয়ে ডেসটিনি বনায়ন করার অভিযোগ এনে পার্বত্য জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করে। অভিযোগের ভিত্তিতে ২৬ আগস্ট জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সরেজমিন কাঁঠালছড়ায় গিয়ে অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পায় এবং অবৈধভাবে বনায়নের সাথে জড়িতা থাকায় ডেসটিনির এজিএম মজিবুর রহমান ও সুপারভাইজার মনু মেম্বারকে আটক ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে নির্দেশ দেয়। নির্দেশের প্রেক্ষিতে মনু মেম্বারের বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং তাকে জেলে পাঠানো হয়। পরে প্রশাসন বান্দরবানে ডেসটিনির বনায়ন কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়।

বন ও ভূমি অধিকার আন্দোলন জেলা সভাপতি জোয়ামলিয়ান আমলাই (জুমলিয়ান বম) বলেন, যে বাগান সৃজনের জন্য ইজরা নেয়া হয়েছে ওই পটে তা-ই করার কথা ইজারা চুক্তিতে উলেখ রয়েছে। অথচ ইজারা গ্রহীতারা সেখানে হর্টিকালচার বা রাবার বাগান করেনি। ডেসটিনি কর্তৃপক্ষ ইজারা চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেই বনায়নের নামে জমির দখল নিয়েছে। তিনি বলেন, প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা বিষয়টি জানলেও ‘অজ্ঞাত কারণে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। তিনি বলেন, ইজারা চুক্তি শর্ত লংঘন করে দীর্ঘদিন হর্টিকালচার ও রাবার বাগান না করা এবং প্রশাসন নিরব থাকায় তদন্ত করে সংশিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান।

ডেসটিনির পরিচালক (ল্যান্ড) ও বান্দরবানের আজিজনগর বিএনপি নেতা নাজেমুল ইসলাম চৌধুরী কাছে স্বীকার করেন, বান্দরবানে ডেসটিনির নিজস্ব কোনো জমি নেই। তারা হর্টিকালচার ও রাবার বাগানের জন্য ইজারা প্রদানকৃত প্লট ইজারা গ্রহীতাদের সাথে ‘সমঝোতা চুক্তি’ করেই সেখানে বনায়ন করছে। নিজস্ব জমি নেই, গত বছর থেকে বনায়ন শুরু করেছেন, অথচ পত্রিকায় বিশাল বাগান সম্বলিত বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে ডেসটিনির নিজস্ব জমিতে বনায়ন কার্যক্রম চলছে, শেয়ার বিক্রির কথা বলা হচ্ছে, এর মাধ্যমে লোকজনের সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে- এক প্রশ্নের জবাবে নাজেমুল ইসলাম বলেন, আমরা কিছু কিছু পুরাতন বনায়নের মালিকদের সাথে চুক্তি করেছি। সেই বাগানের ছবি ছাপা হয়েছে। তিনি বান্দরবান আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতার নাম উলেখ করে বলেন, তারা ফাঁসিয়াখালীর ১২৫ একর রাবার প্লট নিয়ে সেখানে ডেসটিনি বনায়ন করছেন। লামার আরেক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার কাছ থেকেও জমি নিয়ে সেখানে বনায়ন করা হচ্ছে। তবে তিনি জানান, গত মাসে বান্দরবান অর্থঋণ আদালতের মাধ্যমে দেয়া নীলামে অংশ নিয়ে ডেসটিনি ফাঁসিয়াখালী মৌজায় ২৫ একর জমি ৫ লাখ টাকা দিয়ে কিনেছেন।
এদিকে ডেসটিনির বনায়ন কার্যক্রমে অনিয়ম- জমির দখল বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের পর অনেকেই ডেসটিনির প্রতি আস্থা হারিয়ে বলেছেন, এতোদিন ডেসটিনি তাহলে বিশাল বিশাল বন বাগানের ছবি পত্রিকায় ছাপিয়ে লোকজনের সাথে প্রতারণা করেছে। তারা ডেসটিনির এহেন অনিয়ম ও জমি দখলের বিষয়ে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দাবি করেছেন।

মূল নিউজ- ইউকে বিডি নিউজ

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Categories

Powered By Blogger
abrahamalingkon

Social Icons

Popular Posts

Followers

Featured Posts

asbl. Blogger দ্বারা পরিচালিত.

Copyright © / আসুন আমরা ইভটিজিং বন্ধ করি ।

Template by : Urang-kurai / powered by :ahb